আমি সেই দিনটি স্মরণ করতে পারছিনা যে দিন মক্কা ও মদীনার স্মরণ আমার কানে নতুন ছিলো। সেই দিনটি ছিল প্রথম যেদিন আমি রাসূল (সাঃ) এর জন্ম ও ইসলামের সূচনা (দোলনা مهد) নবী (সাঃ) এর মদিনা এবং তার মুহাজিরদের ব্যাপারে শুনেছিলাম। মুসলিমদের সন্তানরা এমন এক পরিবেশে বড় হয়েছে যেখানে হেজাজ এবং তার দুই সম্মানিত শহরের স্মরণ বাদ যায় না। মানুষরা দ্রুত ভারতীয় ছন্দে কথা বলার সময় সর্বদা হারফুল আতফ (واو) ছেড়ে দিত এবং তারা বলত মক্কা মদিনা। অতঃপর আমি একজন ছোট শিশু হিসেবে চিন্তা করতাম, বিভ্রান্তিতে পড়তাম যে সেই দুটি একটি শহর। তারা মদিনাকে বাদ দিয়ে মক্কার কথা খুব কমই উল্লেখ করেছে এবং এইরকম ভাবে তার বিপরীতও (অর্থাৎ তারা শুধু মক্কা বা মদিনা বলতো না বরং বেশিরভাগ সময়ই মক্কা-মদিনা বলতো)। আমি বড়ো এবং বুদ্ধিমান হওয়ার আগে তাদের মধ্যে (মক্কা ও মদীনার মধ্যে) পার্থক্য করতে পারিনি। অতঃপর আমি জানলাম যে তারা দুটি পৃথক শহর এবং তাদের মধ্যে এমন এক দূরত্ব রয়েছে যাকে অবমূল্যায়ন করা যাবে না (অর্থাৎ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দূরত্ব রয়েছে)।
আমি ছোটবেলায় জান্নাত এবং তার নিয়ামত সম্বন্ধে শুনেছি এবং আমি হেজাজ ও তার দুই শহরের কথা একই আকাঙ্ক্ষা ও শ্রদ্ধার সাথে শুনেছি। অতঃপর মোট কথা আমি আকাঙ্ক্ষার সহিত বড় হয়েছি। আমি জান্নাত ও হিজাজের জন্য আকাঙ্ক্ষার সহিত বড় হয়েছি। অতঃপর যখন আমি বড় হলাম জানতে/বুঝতে পারলাম যে এই দুনিয়ায় জান্নাতে যাবার কোনো পথ নাই/উপায় নাই, অতঃপর আমি ধৈর্য ধারণ করেছিলাম এবং নিজেকে থামিয়ে রেখেছিলাম এবং অন্তরকে সান্তনা দিয়েছিলাম। অপরদিকে হেজাজের ব্যাপারে লোকেরা বললো যে সেখানে পৌঁছানো সহজ। এবং আমি হেজাজের কাফেলা গুলো যাওয়ার ব্যাপারে পড়েছি। অতঃপর সেই ব্যাপারে কোন সমবেদনা খুঁজে পাইনি নিজের জন্য এবং সেখানে পৌঁছানোর কোনো অজুহাতও পাইনি। অতঃপর আমি বড়ো হলাম এবং নবী (সাঃ) এর জীবনী, ইসলামের ইতিহাস পড়লাম অতঃপর আমার পুরনো আকাঙ্ক্ষা নতুন করে তৈরি হয়েছিলো, এবং মনে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল এবং আল্লাহ তা'য়ালা আমার ইচ্ছা বাস্তবায়ন করলেন এবং আমি হজ্ব ও জিয়ারতের মাধ্যমে সম্মানিত হলাম।
আমি এই শহরে অবস্থান করেছিলাম যেটি কোন বন্ধ্যা পাহাড় দ্বারা ঘেরা, যেখানে কোন ঘাস, সবুজ যার মধ্য দিয়ে কোনো নদী প্রবাহিত হয়নি। মনোযোগ আকর্ষণ করে বক্ষকে প্রশান্তি দেয়, বিভিন্ন দৃশ্যের কবজ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, কোমল বায়ু, সুমিষ্ট জল ইত্যাদি দ্বারা আত্মাকে তৃপ্তি দেয়। সহজ করে তোলে এমন সবকিছু থেকে সেটি (মক্কা) একদম আলাদা। অতঃপর আমি বললাম সুন্দর দৃশ্যের দিক দিয়ে এই শহর কতই না নিঃস্ব/দরিদ্র, কিন্তু মানুষ্য সমাজ ও বিশ্ব সভ্যতায় তার কতই না মহত্ব। যদি এই শহর না থাকতো যেখানে কোন মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য নেই তাহলে বিশ্বজগৎ সোনার খাঁচার মতো হয়ে যেত। যাতে মানুষ বন্দী পাখির ন্যায় অবস্থান করতো। এটি হলো সেই শহর যেটা মানুষকে দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে সক্ষমতার দিকে নিয়ে গেছে। এবং মানবতার দিক দিয়ে তার স্বাধীনতা ও মর্যাদা ফিরিয়ে এনেছে। এবং তার পূর্বে যে শৃংখলা ও জোর ছিল তা প্রতিস্থাপন করেছে।
আমি বলিনি যদি এই শহরটা না হতো তবে আমার মনে উদয় হলো যে আমি মাপবো/তুলনা করবো বিশ্বের ক্যাপিটাল সিটি এবং শহরগুলোকে এই ন্যায়ের দাঁড়িপাল্লায়। এবং আমি দেখতে চাই মানবতার মধ্যে কোন জিনিসটার ঘাটতি রয়েছে এবং সভ্যতা-সংস্কৃতির কি ঘাটতি রয়েছে যদি এই শহরগুলো না হতো এবং তার প্রশস্ততা আমার সামনে না হতো শহর হিসেবে। তাহলে আমি দেখতে পেতাম যে, এটা শুধু নিজে নিজেই এবং অল্প কতক মানুষ বসবাস করে। এবং এগুলি মানবতার সম্পদে এমন কিছু সংযোজন করতে পারেনি। এবং বিভিন্ন যুগে এই শহরগুলি মানবতা এবং সভ্যতার উপরে এসেছে। অতঃপর কতইনা শহর জনশূন্য হয়ে গেছে এবং কতইনা জাতি অপর জাতির কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে একটি জাতি অনেকগুলো মানুষের কারণে ধ্বংস হয়েছে। সুতরাং না পৃথিবীতে আর না মানবতায় আর না কোন সভ্যতার জন্য যদি এই শহর দুটি না হত তাহলে সেই শহরগুলোর অস্তিত্ব পৃথিবীর মানচিত্রে থাকত না। আর না কোন শহর হতো আর না কোন সভ্যতা।
মক্কার জন্য, মানবতা সবচেয়ে সুন্দর অর্থ এবং তথ্য, বিশ্বাস, নৈতিকতা, বিজ্ঞান এবং গুণাবলী থেকে ছিনিয়ে নিত। এখানে পৃথিবী শতাব্দী আগে হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস খুঁজে পেয়েছিল, এবং সঠিক জ্ঞান খুঁজে পেয়েছিল যা অজ্ঞতার অন্ধকারে হারিয়েছিল। এবং সন্দেহ, এবং অত্যাচারী এবং নিপীড়কদের দ্বারা নষ্ট হওয়া মর্যাদা খুঁজে পেয়েছি, এবং সাধারণভাবে এখানে আমি মানবতাকে নতুনভাবে এবং ইতিহাসকে নতুনভাবে পেয়েছি।
আমি আর কি বলব যদি মক্কা না হতো তার পাহাড় এবং বালি বরং তার বাড়ি এবং তার জমজমের পানির কারণে ষষ্ঠ শতাব্দীর সেই যুগটা জীর্ণগ্রন্থ মানবতা অস্বীকার করতে পারে না। এবং তার দিকে কেউ সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দেবে না। যে শহর আহত ছিল তার পাহাড় আর বালি দ্বারা, যে শহরটা পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে ছিল যেন মনে হচ্ছে সে মানব পরিবারের কেউ নয় এবং এই প্রশস্ত পৃথিবীর কোন একটি অংশ নয়। বরং আমার এটা বলা বেশি উচিত হবে যদি মক্কার এই সন্তানটা না হত যে, ইতিহাসের ধারা পাল্টিয়ে দিয়েছে এবং মানব জীবনে পরিবর্তন এনেছে এবং নতুন করে পৃথিবীকে পরিচালিত করেছে।
এবং এখানে আমি বিভিন্ন দৃশ্য অবলোন করেছি। আমি করাইশ নেতাকে একাই বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করতে দেখেছি এমতাবস্থায় যে তিনি ছিলেন ঠাট্টা বিদ্রূপের পাত্র এবং তার প্রতি অবমাননা ও লাঞ্ছনা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি তার কাজের প্রতি ছিলেন বিনম্র ও বিনীত। অতঃর আমি তাকে দেখলাম সে, তার তাওয়াফ শেষ করে কাবা ঘরে প্রবেশ করার চেষ্ট করছেন। অতঃপর কাবার মুতাওয়াল্লি উসমান বিন ত্বালহা তাকে প্রবেশ করতে বধা দিলেন। অতঃপর তিনি কষ্ট পেয়ে বললেন হে: উসমান তুমি যদি এই চাবিটি দেখতে এমন সময় ছিল যখন এই ছবিটি যেখানে ইচ্ছা রাখতাম। অতঃপর তিনি বললেন (উসমান) কুরাইশরা সেদিন ধ্বংস হয়েছে এবং লাঞ্ছিত হয়েছে। অতঃপর তিনি বললেন বরং তখন আমরা সম্মানের সহিত বেঁচে ছিলাম। অতঃপর যেন আমি তাকে দেখলাম মাক্কা বিজয়ের দিন বায়তুল্লাহর তাওয়া করছেন এবং তার চতুর্পার্শ্বে রয়েছেন তার সঙ্গী সাথীরা যারা তাকে জান প্রান দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। অতঃপর তিনি কাবার মুতাওয়াল্লি কে খুঁজলেন এবং বললেন এই হল তোমার চাবি হে উসমান আজ হল পূন্য এবং ক্ষমার দিন।
ইতিহাস সাক্ষ্য দিয়েছে যে তিনি কেবল যে চাবিটি দিয়ে কাবা খুলতে সক্ষম হয়েছেন তার মালিকানা ছিল না। বরং তিনি সেই চাবির মালিক যার দ্বারা তিনি মানব জাতির জটিল তালাগুলি খুলেছেন যা বিশ্বের সমস্ত বুদ্ধিমান মানুষকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। সেই চাবিটি হলো কোরআন যা তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল। এবং রেসালাত যার দ্বারা আল্লাহ তাঁকে সম্মানীয় করেছেন। তিনি এখনও নতুন সমস্যাগুলি সমাধান করতে এবং নতুন তালাগুলি খুলতে তার সহায়তা চান।
হজের পরে আমি মদিনায় চলে গেলাম , আকাঙ্ক্ষার প্রান্তে , ভালবাসা এবং আনুগত্যের জন্য আমার আবেগের সন্ধানে। আমি ভ্রমণের কষ্ট বহন (সহ্য) করি এবং প্রথম যাত্রীর মতো হই যিনি আলো এবং প্রশান্তিতে স্থানটি পূর্ণ করেছিলেন।এবং আমি মদীনায় পৌঁছে গেলাম এবং আমি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর মসজিদে দুই রাকাত নামাজ পড়লাম এবং আল্লাহর প্রশংসা করলাম। তারপরে আমি ভারাক্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম যার সাথে আমি পুরষ্কারও দিতে পারি না বা তার অধিকারও পূরণ করতে পারি না। এবং তাঁর (সাঃ) উপর দরূদ ও সালাম পড়লাম। এবং সাক্ষ দিলাম যে তিনি বার্তা (রেশালাত) সৌঁছে দিয়েছিলেন , আমানত রেখেছিলেন এবং জাতিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এবং আল্লাহর পথে প্রকৃত জেহাদ করেছেন। এবং আল্লাহর এবাদত করেছেন তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস আসা পর্যন্ত। এবং তাঁর দুই অনুগত ও বিশ্বস্ব সাহাবীকে সালাম করলাম। যাদের মত বিশ্বস্ত সাথী (একে অপরের) মানব ইতিহাস দেখেনি বা কোন খলিফার ভার বহন করার পক্ষে শক্তিশালী, তাঁদের উপর আল্লাহ সন্তুষ্টি হন। অতঃপর আমি আল-বাকির কাছে গেলাম, সেই ছোট্ট জায়গা যা সততা, নির্মলতা, সদয়তা এবং আনুগত্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় সম্পদকে গ্রহণ করে আছে। সেখানে অনেক ব্যাক্তি দুনিয়ার থেকে আখেরাতকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলো। দেশের আকাঙ্খা ও আরামের থেকে আকিদা ও ঈমানের জন্য বিচ্ছিন্নতা ও হিজরতকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলো। তারা প্রিয়জন এবং আত্মীয়স্বজনের সান্ন্যিধ্যের চেয়ে রাসূলের সান্নিধ্য পছন্দ করেছিল। তারা তাঁর নিকট থেকে স্থানান্তর আসা করেনি, অথবা তারা তার বিনিময়েও কিছু চায়নি :- “ মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে।"
এবং আমি উহুদ যুদ্ধে গেলাম, সেই ঘটনাটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্দান্ত উপন্যাস এবং সর্বাধিক প্রভাবকে উপস্থাপন করেছে, ইমান ও দৃঢ় বিশ্বাসের উপন্যাস, বীরত্ব ও আনুগত্যের উপন্যাস, খাঁটি প্রেম এবং বিরল আনুগত্যের উপন্যাস যেন আমি আনাস বিন নজরের কাছ থেকে শুনছি। আমি কাউকে ছাড়াই জান্নাতের বাতাস পাব এবং সাদ ইবনে মুআয বলেছেন: “ মুহাম্মদ (সাঃ) এর পরে যুদ্ধে আমরা কী করব? এবং মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গেলো যে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। অতঃপর আনাস বললেন: " আমরা মুহাম্মদ (সাঃ) এর পরে জীবন নিয়ে কী করবো? এবং উহুদ যুদ্ধে আবু দুজনা রাসূল (সাঃ) কে আবৃত করে রেখেছিলেন তাঁর পিঠ দ্বারা এবং তীর গুলো পড়ছিলো তাঁর উপর৷ এবং সেখানে তালহা হাত দ্বারা আবৃত করে রেখেছিলেন এমনকী সেটা অবশ হয়ে গিয়েছিলো৷ এবং সেখানে হামজাকে হত্যা করা হয়েছিল এবং চেহারাকে বিকৃত করে দেওয়া হয়েছিল। তারা পাইনি যার দ্বারা কাফন দিতে পারে শুধুমাত্র একটি কাপড় ছাড়া যা দ্বারা সম্পূর্ণ শরীর ঢাকেনি। হায় আফসোস! কেও যদি বিশ্বকে এই প্রেম ভালোবাসা দিতে পারতো এবং ঈমান ও দৃঢ় বিশ্বাস থেকে কিছু দিতে পারতো তাহলে পৃথিবীটা বদলে যেত।
তারা আমাকে বললো আমাদের কাইরো এবং তার জীবনের ব্যাপারে বর্ণনা করলো এবং দেমাষ্ক ও তার মানুষদের ব্যাপারে৷ অতঃপর সে হেজাজের ব্যাপারে বর্ণনা করলো। আমি বললাম হেজাজের বাণীতে নিশ্চয় একটা গুরুত্বপূর্ণ রং রয়েছে। তার আশপাশটা মহান ব্যাক্তি দ্বারা বেষ্টিত। তার রেশালাত এবং ইতিহাসের দ্বারা মিলেছে। নিশ্চয় কথাটি ইসলামের কোলে এবং রাসূল (সাঃ) এর শহর নিয়ে।